সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক: এই লেখার সময় পর্যন্ত পুরো বিশ্বে ৩৫টি বায়োফার্মা কোম্পানি এবং ইউনিভার্সিটি ল্যাব করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে ৪টি ভ্যাকসিন এর এনিম্যাল টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে। মার্কিন কোম্পানি Moderna সর্বপ্রথম মানব শরীরে ট্রায়াল শুরু করেছে। আরো বেশ কিছু ভ্যাকসিন এর হিউমান ট্রায়াল শুরু হতে যাচ্ছে শ্রীঘ্রই।
তাহলে কি খুব শীঘ্রই আমরা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ব্যবহারের জন্য পেতে যাচ্ছি? দুঃখজনকভাবে এর উত্তর হচ্ছে - "না"। যদি সব ধাপ এক বারেই আমরা অতিক্রম করতে পারি তাহলেও এই ভ্যাকসিন পেতে আমাদের আরো এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে। কিন্তু কেন? জানতে হলে আমাদের বুঝতে হবে করোনা ভাইরাস এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কার সম্পর্কে কিছু জরুরি কথা।
করোনা ভাইরাস একটি positive stranded RNA ভাইরাস। এই ধরণের ভাইরাসের বিভিন্ন structural এবং non - structural প্রোটিন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের খুব ভালো জ্ঞান রয়েছে, যা এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার পথ কিছুটা সহজ করে দিয়েছে। উপরন্তু চীনে করোনা ভাইরাস এর আক্রমণের পর সেদেশের বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল সিকুয়েন্সিং করেছেন এবং সেই তথ্য সারা বিশ্বের সব বিজ্ঞানীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ২০০২ সালে চীনের Sars ভাইরাসের জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল এর সাথে করোনা ভাইরাসের জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল এর প্রায় ৮০-৯০% মিল রয়েছে। এসব কারণে এখন পর্যন্ত ৩৫ টি ল্যাবে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা হয়েছে।
খুশির ব্যাপার, তাইনা? কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে সব আবিষ্কারই মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারেনা। কেন পায়না সেটা জানতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে একটি ভ্যাকসিন ল্যাবে আবিষ্কার হবার পর থেকে মানুষের ব্যবহার উপযোগী হবার মাঝে কি কি সাইন্টিফিক স্টেপ ফলো করতে হয়।
ল্যাবে ভ্যাকসিন এর প্রোটোটাইপ আবিষ্কারের পর সেটি প্রথমে পরীক্ষা করা হয় অন্য প্রাণীর শরীরে, যেমন - ইঁদুর, খরগোশ, গিনিপিগ, বা বানর। এই ধাপে দুটি বিষয় যাচাই করা হয় - ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কিনা এবং সেটি ওই প্রাণীর শরীরে কাজ করছে কিনা। অধিকাংশ ভ্যাকসিনই এই ধাপে ঝরে যায়। যেসব ভ্যাকসিন এই ধাপ পার করতে পারে, তাদেরকে তখন হিউমান ট্রায়াল এর জন্য নির্বাচিত করা হয়। হিউমান ট্রায়াল তিন ধাপে করা হয়। ফেজ ১ ট্রায়াল এ সাধারণত কয়েক ডজন সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে ভ্যাকসিনটি ইঞ্জেক্ট করে দেখা হয় ভ্যাকসিনটি মানুষের শরীরে ব্যবহার করার জন সেফ কিনা এবং ভ্যাকসিনটি আমাদের শরীরে সঠিক ইমিউন রেসপন্স তৈরী করছে কিনা। ফেজ ২ ট্রায়াল করা হয় কয়েকশো মানুষের মধ্যে, আর ফেজ ৩ ট্রায়াল করা হয় কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে। সবগুলি ট্রায়াল ফেজেই একদলকে ভ্যাকসিন দিয়ে আর অন্যদলকে প্লাসেবো (দেখতে ভ্যাকসিনের মত কিন্তু ভ্যাকসিন নয়) দিয়ে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং সেফটি দেখা হয়। সবগুলি ট্রায়াল ফেজে কার্যকারিতা এবং সেফটি প্রমাণিত হলেই অনুমোদন মিলে ভ্যাকসিন বাণিজ্যিকভাবে তৈরী করার। এই ধাপগুলি সম্পন্ন করতে কয়েক বছর থেকে শুরু করে এক যুগের বেশি সময়ও লেগে যেতে পারে। যেমন - ইবোলা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে সর্বসাকুল্যে ৬ বছর সময় লেগেছিলো।
করোনা ভাইরাস যেহেতু মহামারী আকার ধারণ করেছে, সেহেতু এর ভ্যাকসিন পেতে কি কিছু ধাপ না মেনে গেলে হয় না? না, হয়না। তবে আশার বিষয় হচ্ছে FDA থেকে এনিম্যাল এবং হিউমান ট্রায়াল একইসময়ে করার পারমিশন দেয়া হয়েছে, যাতে করে ধাপগুলি তাড়াতাড়ি সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আরো বড় একটি বাধা হচ্ছে FDA এর অনুমুতি পাওয়ার পর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন করতে আরো বেশ কিছু সময় চলে যায়। FDA কিছু কোম্পানিকে রিস্ক নিয়ে আগে ভাগেই বাণিজ্যিক উৎপাদন করার জন্য বলছে - রিস্ক এই জন্য যে যদি প্রমাণিত হয় যে ভ্যাকসিনটি কার্যকর বা সেফ নয়, তাহলে কোম্পানির পুরো ইনভেস্টমেন্ট লস হবে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন সবকিছু যদি প্ল্যানমাফিক হয় তাহলে হয়তো আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে আমরা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারবো।
ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। সব ভ্যাকসিন কিন্তু মানবদেহে প্রবেশের পর ওই ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে পারেনা, অনেক সময় ভাইরাসের আক্রমণকে উল্টা আরো তীব্র করে ফেলে। যেমন - respiratory syncytial virus এর ভ্যাকসিন শিশুদের শরীরে দেয়ার পর ওই ভাইরাস শিশুদেরকে আরো বেশি অসুস্থ করেছিল। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে এনিম্যাল ট্রায়ালে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অনেকসময় ভাইরাস কিন্তু নিজের রূপ পরিবর্তন করে এবং তখন ভ্যাকসিন কাজ করে না। করোনা ভাইরাসের স্পাইক (S) প্রোটিন এর বিরুদ্ধে এখন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হচ্ছে, কিন্তু কিছু কিছু ল্যাবে মেমব্রেন (M) এবং এনভেলপ (E) প্রোটিনের বিরুদ্ধেও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজ হচ্ছে।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমাদেরকে বেশকিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন পাবার জন্য। তাই আসুন বেশি বেশি করে বাসায় থাকি এবং হাত পরিষ্কার করি, যাতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারি আমরা।
বি. দ্র. ভ্যাকসিন নিয়ে আমি গবেষণা করিনা। তাই এই লেখাটি লেখার সময় আমি Dr Gregory Poland, Director, Mayo Vaccine Research Group এবং Dr Fauci, Director, National Institute of Allergy and Infectious Diseases, USA এর দুটি ইন্টারভিউ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি।
লেখনী:
ডাঃ মোঃ সাজেদুর রহমান শাওন
এপিডেমিওলোজিস্ট
ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া
তাহলে কি খুব শীঘ্রই আমরা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ব্যবহারের জন্য পেতে যাচ্ছি? দুঃখজনকভাবে এর উত্তর হচ্ছে - "না"। যদি সব ধাপ এক বারেই আমরা অতিক্রম করতে পারি তাহলেও এই ভ্যাকসিন পেতে আমাদের আরো এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে। কিন্তু কেন? জানতে হলে আমাদের বুঝতে হবে করোনা ভাইরাস এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কার সম্পর্কে কিছু জরুরি কথা।
করোনা ভাইরাস একটি positive stranded RNA ভাইরাস। এই ধরণের ভাইরাসের বিভিন্ন structural এবং non - structural প্রোটিন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের খুব ভালো জ্ঞান রয়েছে, যা এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার পথ কিছুটা সহজ করে দিয়েছে। উপরন্তু চীনে করোনা ভাইরাস এর আক্রমণের পর সেদেশের বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল সিকুয়েন্সিং করেছেন এবং সেই তথ্য সারা বিশ্বের সব বিজ্ঞানীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ২০০২ সালে চীনের Sars ভাইরাসের জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল এর সাথে করোনা ভাইরাসের জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল এর প্রায় ৮০-৯০% মিল রয়েছে। এসব কারণে এখন পর্যন্ত ৩৫ টি ল্যাবে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা হয়েছে।
খুশির ব্যাপার, তাইনা? কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে সব আবিষ্কারই মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারেনা। কেন পায়না সেটা জানতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে একটি ভ্যাকসিন ল্যাবে আবিষ্কার হবার পর থেকে মানুষের ব্যবহার উপযোগী হবার মাঝে কি কি সাইন্টিফিক স্টেপ ফলো করতে হয়।
ল্যাবে ভ্যাকসিন এর প্রোটোটাইপ আবিষ্কারের পর সেটি প্রথমে পরীক্ষা করা হয় অন্য প্রাণীর শরীরে, যেমন - ইঁদুর, খরগোশ, গিনিপিগ, বা বানর। এই ধাপে দুটি বিষয় যাচাই করা হয় - ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কিনা এবং সেটি ওই প্রাণীর শরীরে কাজ করছে কিনা। অধিকাংশ ভ্যাকসিনই এই ধাপে ঝরে যায়। যেসব ভ্যাকসিন এই ধাপ পার করতে পারে, তাদেরকে তখন হিউমান ট্রায়াল এর জন্য নির্বাচিত করা হয়। হিউমান ট্রায়াল তিন ধাপে করা হয়। ফেজ ১ ট্রায়াল এ সাধারণত কয়েক ডজন সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে ভ্যাকসিনটি ইঞ্জেক্ট করে দেখা হয় ভ্যাকসিনটি মানুষের শরীরে ব্যবহার করার জন সেফ কিনা এবং ভ্যাকসিনটি আমাদের শরীরে সঠিক ইমিউন রেসপন্স তৈরী করছে কিনা। ফেজ ২ ট্রায়াল করা হয় কয়েকশো মানুষের মধ্যে, আর ফেজ ৩ ট্রায়াল করা হয় কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে। সবগুলি ট্রায়াল ফেজেই একদলকে ভ্যাকসিন দিয়ে আর অন্যদলকে প্লাসেবো (দেখতে ভ্যাকসিনের মত কিন্তু ভ্যাকসিন নয়) দিয়ে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং সেফটি দেখা হয়। সবগুলি ট্রায়াল ফেজে কার্যকারিতা এবং সেফটি প্রমাণিত হলেই অনুমোদন মিলে ভ্যাকসিন বাণিজ্যিকভাবে তৈরী করার। এই ধাপগুলি সম্পন্ন করতে কয়েক বছর থেকে শুরু করে এক যুগের বেশি সময়ও লেগে যেতে পারে। যেমন - ইবোলা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে সর্বসাকুল্যে ৬ বছর সময় লেগেছিলো।
করোনা ভাইরাস যেহেতু মহামারী আকার ধারণ করেছে, সেহেতু এর ভ্যাকসিন পেতে কি কিছু ধাপ না মেনে গেলে হয় না? না, হয়না। তবে আশার বিষয় হচ্ছে FDA থেকে এনিম্যাল এবং হিউমান ট্রায়াল একইসময়ে করার পারমিশন দেয়া হয়েছে, যাতে করে ধাপগুলি তাড়াতাড়ি সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আরো বড় একটি বাধা হচ্ছে FDA এর অনুমুতি পাওয়ার পর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন করতে আরো বেশ কিছু সময় চলে যায়। FDA কিছু কোম্পানিকে রিস্ক নিয়ে আগে ভাগেই বাণিজ্যিক উৎপাদন করার জন্য বলছে - রিস্ক এই জন্য যে যদি প্রমাণিত হয় যে ভ্যাকসিনটি কার্যকর বা সেফ নয়, তাহলে কোম্পানির পুরো ইনভেস্টমেন্ট লস হবে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন সবকিছু যদি প্ল্যানমাফিক হয় তাহলে হয়তো আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে আমরা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারবো।
ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। সব ভ্যাকসিন কিন্তু মানবদেহে প্রবেশের পর ওই ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে পারেনা, অনেক সময় ভাইরাসের আক্রমণকে উল্টা আরো তীব্র করে ফেলে। যেমন - respiratory syncytial virus এর ভ্যাকসিন শিশুদের শরীরে দেয়ার পর ওই ভাইরাস শিশুদেরকে আরো বেশি অসুস্থ করেছিল। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে এনিম্যাল ট্রায়ালে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অনেকসময় ভাইরাস কিন্তু নিজের রূপ পরিবর্তন করে এবং তখন ভ্যাকসিন কাজ করে না। করোনা ভাইরাসের স্পাইক (S) প্রোটিন এর বিরুদ্ধে এখন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হচ্ছে, কিন্তু কিছু কিছু ল্যাবে মেমব্রেন (M) এবং এনভেলপ (E) প্রোটিনের বিরুদ্ধেও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজ হচ্ছে।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমাদেরকে বেশকিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন পাবার জন্য। তাই আসুন বেশি বেশি করে বাসায় থাকি এবং হাত পরিষ্কার করি, যাতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারি আমরা।
বি. দ্র. ভ্যাকসিন নিয়ে আমি গবেষণা করিনা। তাই এই লেখাটি লেখার সময় আমি Dr Gregory Poland, Director, Mayo Vaccine Research Group এবং Dr Fauci, Director, National Institute of Allergy and Infectious Diseases, USA এর দুটি ইন্টারভিউ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি।
লেখনী:
ডাঃ মোঃ সাজেদুর রহমান শাওন
এপিডেমিওলোজিস্ট
ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন